তিনটি আলাদা ছবি। কিন্তু ভাষা এক—হৃদয়ভঙ্গ। প্রথমেই আসবেন রায়ার্ন বার্ল। ৩৯তম ওভারে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলে ১০ রান তুলে নেওয়ার পর চতুর্থ বলে ওই শটটা ছিল ‘আত্মঘাতী’। বন্দুক থেকে গুলি বের হয়ে যাওয়ার পর লোকে যেমন বুঝতে পারে, বার্লেরও তেমনি শটটা খেলার পর চৈতন্য জাগ্রত হয়েছিল। স্কটল্যান্ডের ব্রান্ডন ম্যাকমুলেন ক্যাচটা নেওয়ার পর বার্লের মুখে স্রেফ তাকানো যাচ্ছিল না। গোটা জাতি তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল। বার্ল আশার তরি প্রায় একাই টেনে আনার পর তাঁর ভুলেই আশাভঙ্গ। বার্ল কি কখনো নিজেকে মাফ করতে পারবেন!
বার্ল যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছিলেন, তখন ক্যামেরা ঘুরে গেল জিম্বাবুয়ের ড্রেসিংরুমে। হুডি পরে বসে ছিলেন সিকান্দার রাজা—জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটের ‘রবিন হুড’। তাঁর বীরত্বে পরাশক্তির বিপক্ষে কম ম্যাচ জেতেনি জিম্বাবুয়ে। কিন্তু রাজা মাথা নিচু করে দু হাতে মুখ ঢাকলেন। বোঝাই যাচ্ছিল, ধরণী দ্বিধা হও—আমি মুখ লুকাই! ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে এই রাজাই ১৯৬ রান করার পাশাপাশি ১২ উইকেট নিয়েছিলেন। জিম্বাবুয়ে তবু চূড়ান্তপর্বে উঠতে পারেনি। এবারের বাছাইপর্বে সেই রাজাই যেন ‘সম্রাট’—৩২৫ রান করেছেন ব্যাটে, বল হাতে ৯ উইকেট। তবু চূড়ান্তপর্বের টিকিট মিলল না। ৩৭ বছর বয়সী রাজা জানেন ২০২৭ আসার আগেই জায়গা ছাড়তে হবে। ওই নত মস্তকের অর্থ তাই পরিষ্কার—রাজা হয়েও বিদায় নিতে হবে প্রজার মতো।
কয়েক মিনিট পর সবচেয়ে কঠিন কাজটা করতে হলো জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক ক্রেগ আরভিনকে। ৮৩ রান করেও ‘অপরাধী’ বার্ল কিংবা রাজাকে জিম্বাবুয়ের বিদায় নিয়ে কথা বলতে হয়নি। আরভিন যেহেতু অধিনায়ক তাই দায়িত্বটা তাঁর ওপরই বর্তায়।টিভিতে ম্যাচের সম্প্রচারকদের সঙ্গে আরভিন যখন কথা বলছিলেন, তাঁর মুখের দিকেও তাকানো যাচ্ছিল না। বোঝা যাচ্ছিল, আরভিনের কাছে এর চেয়ে এভারেস্টে ওঠাও সহজ। প্রথম কথাতেই সেটা বুঝিয়ে দিলেন, ‘এটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন…।’বাংলাদেশী ক্রিকেট সমর্থকদের উদ্দেশ্যে সিকান্দার রাজা বলেন যেভাবে ওরা আমাদেরকে সারা টুর্নামেন্টে সাপোর্ট করেছে তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক বাছাইপর্বে তাঁর সতীর্থদের পারফরম্যান্সে ‘ভীষণ, ভীষণ সন্তুষ্ট।’ কিন্তু আরভিন এই কথাগুলো যখন বলছিলেন, তাঁর চোখমুখ কুঁচকে আসছিল। আরভিন আসলে তুমুল অশ্রুর ঢল থামাতে ভেতরে ভেতরে বাঁধ দিচ্ছিলেন—মাইক্রোফোনের সামনে কথাগুলো স্রেফ দর্শক ও শ্রোতার মনোযোগ সরানোর চেষ্টা। আরভিন সেই চেষ্টায় সফল হননি।আসলে ওই পরিস্থিতিতে সম্ভবত কেউ–ই তা পারে না। পাঁচ বছর আগের বাছাইপর্বে তাকানো যাক। জয়, জয়, জয়, টাই, জয়, হার, হার—ব্যস, জিম্বাবুয়ের বিশ্বকাপে খেলার আশা শেষ। এবার? জয়, জয়,জয়, জয়, জয়, হার ও হার—জিম্বাবুয়ের বিশ্বকাপে খেলার আশা শেষ। দুবারই শেষ দুই ম্যাচের একটি জিতলেই হয়ে যেত। হলো না!
আরভিনদের এই কষ্টের আসলে কোনো সান্ত্বনা হয় না। ক্রিকেট কখনো কখনো বড় নির্মম। সামান্য একটি ভুলের মাশুল দিতে হয় আবারও চার বছরের অপেক্ষায়। এর মধ্যে একটি–দুটি প্রজন্ম হয়তো হারিয়ে যাবে বিশ্বকাপে খেলার স্বাদ না পেয়েই। শন উইলিয়ামসের কথাই ধরুন—বাছাইপর্বে ৩ সেঞ্চুরিসহ ৭ ম্যাচে ১০০ গড়ে ৬০০ রান করেও বিশ্বকাপে খেলা হবে না। বয়স তাঁর ছত্রিশ। এবার যেহেতু হলো না, আর বোধহয় হবেও না।অথচ অনেক কিছুই হওয়ার কথা ছিল। গত বছরের জুনে কোচ হন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে সোনালি অতীতের সন্তান ডেভ হটন। পরের মাসে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার টিকিট পেল জিম্বাবুয়ে। এরপর সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ওয়ানডে সিরিজে স্বাগতিকদের বিপক্ষে একটি ম্যাচ জিতে চমকে দিয়েছিল হটনের দল। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ারই বিপক্ষে সেটি ছিল জিম্বাবুয়ের প্রথম জয়। কিন্তু যাত্রার সেখানেই শেষ নয়।
টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে সুপার টুয়েলভেও উঠেছিল জিম্বাবুয়ে। সেই পর্বে ২৭ অক্টোবরের ম্যাচটি মনে রাখবে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট। সেই টুর্নামেন্টের রানার্সআপ পাকিস্তানকে ১ রানে হারিয়ে ছাইভস্ম থেকে পুনর্জন্মের বার্তা দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। কিন্তু তারপর নয় মাসের মাথায় এসে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে সেই মর্সিয়া–গীতই ফিরে এলো!মাঠের খেলায় পারফরম্যান্সের কাটাছেঁড়া তো হবেই, ভাগ্যও কি জিম্বাবুয়ের প্রতি সুদৃষ্টি দিয়েছে? ২০১৮ সালের সেই বাছাইপর্বে আরব আমিরাতের বিপক্ষে ২৩৬ রান তাড়া করে ৩ রানের হারে বিদায় নিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। এবার স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে লক্ষ্যটা ছিল মাত্র ১ রান কম—২৩৫। হারেও আছে সেই ‘অপয়া’ সংখ্যাটা ৩—এবার হার ৩১ রানে।তিন বছর আগে একটি টুইট করেছিলেন রায়ান বার্ল। আর্থিকভাবে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট কতটা দুর্দশাগ্রস্ত সেটি বোঝাতে নিজের ছেঁড়া জুতোর ছবি টুইট করেছিলেন। বার্ল সেই টুইটে বুঝিয়েছিলেন, জুতার তলা খুলে যাওয়ার পরও সেটায় আঠা লাগিয়ে পরের সিরিজের জন্য প্রস্তুত হন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা। বার্ল পরে স্পনসর পেয়েছেন, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় খানিকটা এগিয়েছিল। এই হারে ঠিক পিছিয়ে পড়ল ঠিক ততটাই।